উন্মাদ মেকুরের আত্মদর্শন - ১

July 30, 2020


ইতিহাসের বাইরেও একটা সময় থাকে। আমরা সেই পাট্টাবিহীন সময়কে হেয় করি, যেন তা নষ্ট। আমাদের সবসময়ের প্রয়াস থাকে ইতিহাসের বাইরের সময়কে যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলা, নিশ্চিহ্ন করে ফেলা, তাকে ইতিহাসের অন্তর্বতী করে ফেলা। অথচ সময় ঢালু জমির জলের মত ইতিহাসের দিক থেকে বিপরীত দিকে বয়ে যেতে চায়। মানুষের প্রতিদিনের লড়াই এই পালানো সময়কে উজানে টেনে আনা।

কিন্তু এই লড়াইয়ের সঙ্গে আমরা সাধারণ লোকেরা সচেতন ভাবে ওয়াকিবহাল থাকি না। এটা আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার ভেতরে অভ্যাসের মত চলতে থাকে। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে ঘুমোতে যাবার আগের মুহূর্ত অবধি আমাদের সকল ইন্দ্রিয়প্রয়াস থাকে 'সময় নষ্ট' না করার দিকে। তাহলে প্রশ্ন হল, যে 'নষ্ট' সময় ইতিহাসের নয়, তা কি আসলে বরবাদ হওয়া সময়, ইংরাজিতে বললে
  wasted ; না কি তা 'পূতি' বা পচে যাওয়া সময়, ইংরাজিতে বললে putrid? আরো সহজ করে জানতে চাইলে, কিছু-না -করে কাটানো আমাদের যে সময়, তা-কি ইতিহাসের বাইরে এবং নষ্ট ; না-কি যে সময় কেটেছে আত্মধ্বংসী (সমস্ত ধ্বংসই কোনো না কোনো ভাবে বিষয়ীর আত্মধ্বংসের উপাদান হয়ে ওঠে) কোনো কাজে বা চিন্তায়, সেই সময় ইতিহাসের বাইরের সময়? স্পষ্টতই দ্বিতীয় প্রস্তাবনাটি একক ভাবে সত্য হতে পারে না, কারণ ইন্দ্রিয়ের এবং করণসমূহের যেকোনো সাধন, যার একটি ফল রয়েছে, তা ইতিহাস থেকে পালাবে কী করে? আমাদের চেতনার ভেতরে বসে যে গজতুণ্ড ইতিহাস-পুরুষ সময়-ব্যাসের (অর্থাৎ ভাঙা মুহূর্তের) বয়ানে সব কাহিনি নিয়ত লিখে চলেছেন, তিনি অর্থ না বুঝে কোনো উপাদান সংযোজিত করতে পারবেন না। এই শর্তের বাইরে লুকিয়ে পড়ল যে সময়, যা হয়ত ব্যাসের একটি দীর্ঘশ্বাস, বা কিছুক্ষণের নৈঃশব্দ, জল খাওয়ার বিরতি, বা দেহযন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়াসমূহের অবকাশ, এবং সর্বোপরি, জটিলতম অর্থনিষ্পত্তির জন্যে ব্যয়িত সময়- এইসব অরক্ষিত সময় কোথায় যাবে?

এখানে এই প্রশ্নও জরুরি, যে ইতিহাস বলতে আমরা কী বুঝছি। যদি আমি বলি, সারাদিন, সারামাস, সারাবছর, সারাজীবনের শেষে বিচার করতে বসলে অতিক্রান্ত সময়ের যেটুকু মনে থাকবে নানা কার্যে, ঘটনায়, অনুভবে, অভিজ্ঞতায় - সেটুকুই ইতিহাস, তাহলে প্রশ্ন উঠবে, তা কি স্মৃতি নয়? ইতিহাস নিশ্চিতভাবেই স্মৃতির অতিরিক্ত কিছু। রবীন্দ্রনাথ 'জীবনস্মৃতি'তে যেটুকু লিখলেন, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন এমন সকম মানুষের সকল স্মৃতিকথা একত্র করেও যদি কোনো স্মৃতি-গ্রন্থ রচনা করা হয়, রবীন্দ্রনাথের জীবনের ইতিহাস তার চেয়ে অনেক বড়। কেন বড়?
  কারণ তার মধ্যে এমন অনেক ঘটনা আছে, যার উৎস বা যার করণ কোনোটাই কোনো স্মৃতিতে নেই, কিন্তু যার ফল অবিসংবাদী ভাবে পৃথিবীর মানুষের কিছু 'প্রকাশের ব্যথা' দূর করেছে, রক্তমাংস অনুপরমাণুর জগতে কিছু অলৌকিক, অনির্বচনীয় আনন্দের সংস্থান করেছে। অর্থাৎ, 'স্মৃতি' হল ব্যক্তি-কেন্দ্রিক, 'ইতিহাস' ব্যক্তি-অতিক্রমী। 

এ-হেন ইতিহাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট যে সময়, তার পরিসরও কিন্তু অনেক বড়ো এবং সূক্ষ্ম। এবং সময় 'নষ্ট' করার প্রাত্যহিক পরম্পরাও কিন্তু বহু-বিচার্য। আপাতভাবে যেটা আমাদের 'সময় নষ্ট' করা মনে হতে পারে, প্রকৃত প্রস্তাবে হয়ত সেই অলস একাকী সময়ের মধ্যে তৈরি হয়েছে আশু কোনো প্রকল্পের কাঠামো, মেধা ও অনুভূতির ফসলের বীজতলা। যদিও সেই সময় ইতিহাসে থাকে না, তবুও সেই সময় ইতিহাসের অংশ হওয়ার দাবীদার।

কিন্তু আমরা সাধারণভাবে সেই সময়কেও নষ্ট বলি। অর্থাৎ, যে সময় আমরা কোনো 'কাজ' করছি না, সেই সময়টা নষ্ট। আবার, যদি কোনো কাজ করতে স্বীকৃত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় নিই, তাহলে সেটাও 'সময় নষ্ট'।
  যেমন ধরা যাক খাবার সময়। প্রতিদিন আমরা খেতে বসি, বেশ কয়েকবার। যদি খেতে অনেকটা বেশি সময় লাগাই, তাহলে সেটা খানিক 'সময় নষ্ট' বলে চিহ্নিত হতে পারে সাধারণ ধারণায়।

কিন্তু, প্রশ্ন হল, যখন খাচ্ছি সেই সময়টা ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত নয় (যদি না খুব বিশেষ কিছু ঘটনা ঘটে থাকে), কিন্তু তাকে আমরা 'নষ্ট' মনে করি না। যখন ঘুমাচ্ছি, তখন তবুও স্বপ্ন দেখতে পারি, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই দেখিনা। যখন বাহ্যে যাচ্ছি, কিংবা হাঁচছি, কাশছি, ঢেঁকুর তুলছি, ব্রাশ করছি, সাবান মাখছি - এর কোনোটাই 'সময় নষ্ট' বলে আমরা সাধারণতঃ ভাবি না, কারণ এই সবকিছুরই একটা জৈব প্রয়োজনীয়তা আছে; কিন্তু এর কোনোটাই ইতিহাসের মুহূর্ত নয়। কারণ, ইতিহাসের মুহূর্ত হতে গেলে বুঝি জৈবতাকে (এবং ব্যক্তিকতাকে) অতিক্রম করতে হয়।

তাহলে কি ইতিহাসের বয়ানের মধ্যে স্বতই এবং সততই বস্তু-অতিক্রমী অধিবিদ্যার বীজ ঢুকে আছে? অধিবিদ্যাকে বাদ দিয়ে ইতিহাসের নির্মাণ তবে নেই, ফলতঃ বিনির্মাণ আছে কি না তা বিচার্য। তবে সে আলোচনা এই পরিসরে নয়। এখানে আমরা 'নষ্ট' সময় নিয়ে ভাবছি।


জৈব ক্রিয়া সংক্রান্ত ভাবনায় দেখা গেল, সেই বিশেষ ক্রিয়ার অন্-ইতিহাস সময়কে আমরা সাধারণতঃ  'নষ্ট' বলে চিহ্নিত না করলেও কোনো ক্রিয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় যে ধার্য সময়, কর্তা তার বেশি সময় নিলে আমরা তা 'সময় নষ্ট' বলে ধরে নিই। যেমন মাত্রাতিরিক্ত সময় ধরে ভোজন অথবা শয়ন। কিন্তু রমণ?  রমণের সময়ের কোনো 'অতিরিক্ত' হয় কি?  কোনো প্রামাণ্য সময় নির্ধারিত করা আছে কি, যার অতিরিক্ত ক্ষণ ধরে রমণ নামক জৈব (?) ক্রিয়াটি চললে আমরা সাধারণভাবে 'সময় নষ্ট' বলে ধরে নিই? না, নেই। বরং বিপরীতটাই এখানে কাম্য, এখানে উদ্বৃত্ত আনন্দেরই (নাকি উদ্বৃত্ত যাতনার?) জয়জয়কার, ফলে অতিরিক্ত সময়টাই মূল পাওনা। তাহলে বলা যেতে পারে আমরা রমণকে কেবলমাত্র জৈব ক্রীড়া বলে বিচার করিনা। এ বড় আজব কুদরতি! এই কুদরতি দেহ দিয়ে শুরুও হয়না, শেষও হয়না, কিন্তু সাঁকোর মত দেহ জুড়ে রাখে কামনার এপার-ওপার।

নাকি রমণ একের ক্রিয়া নয়, অন্ততঃ দুই-এর (বাহ্যতঃ না হলেও অন্তর্গত দুই-এর) বলেই এ আর কেবলমাত্র ব্যক্তিক থাকে না, স্মৃতিমুহূর্ত থেকে ব্যক্তি-অতিক্রমী ইতিহাস-মুহূর্তে উত্তীর্ণ হয়? উপরন্তু, রমণ যদি সহেতু হয়, তবে ইতিহাসের অভিজ্ঞান-স্বরূপ একটি নতুন প্রাণ তৈরি হয়। তা না হলেও, রমণ নিজেই একটি অভিজ্ঞান স্বরূপ কাজ করে জীবনেতিহাসের আর একটি অন্যতম উপাদান 'প্রেম' -কে ধারণ করতে। তা মুহূর্তের প্রেম হতে পারে, অনন্তের হতে পারে, ব্যক্ত হতে পারে, গুপ্ত হতে পারে - কিন্তু সে কথা ইতিহাস থেকে কভু আর পারে না ঘুচিতে। আছে সে নিখিলের মাধুরীরুচিতে।

কিন্তু এ-কথাও নয়, আগে কহি আর।

এই যে গোপন কথা-ইতিহাসকে 'নিখিলের মাধুরীরুচিতে' অভিনিবিষ্ট করার প্রকল্প, তা কি কবিতারও নয়?  নিখিলের মাধুরীরুচিতে না মেশালে সেই কথা চিরস্থায়ী হবে কি? বা, সেই কথার নিখিলের মাধুরীরুচিতে মিশে যাবার যে মুহূর্ত, তা কবিতার মুহূর্ত নয় কি? অবশ্যই। এখানেই প্রশ্ন, যে সময়ে সেই মহামুহূর্তকে অক্ষরমালায় বেঁধে প্রকাশ করেন কবি, সেই সময়ের হিসেব কে দেবে? তা কি নষ্ট হল, না কি ইতিহাস হল? যে সময়টিতে কবিতা লেখা হচ্ছে, তার আগের সময় ও তার ভাবনামালা, এবং তার পরের সময়পর্ব ও তার অনুভূতিমালা - দুইই ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে যায় যদি, তবে মাঝখানের সময় কোথায় হারিয়ে যায়?  কবিও তাকে মনে রাখেননা, পাঠকও না। কবিতায় সে অমর হয়ে বেঁচে থাকে না, আবার কবিতাটি রইল বলে তার মরার খবরও তো আসে না। মগজ থেকে কলমে পৌঁছোনোর ক্ষুরধার পথ পার হবার সময়টুকু তাহলে শুধু নষ্ট নয়, সে বিস্মৃত, অবলুপ্ত। 

(কেবলমাত্র এই কারণেই, কবিতার রচনামুহূর্তে কবি কী দেখছেন তা কবিতার রহস্য-বিচারের প্রশ্নে অবান্তর হয়ে যায়।)

যেমনটি রাগমোচনের তুঙ্গমুহূর্ত। ওই বিন্দুতে কী হয়েছিল তা আর মনে নেই কারো। তার আগের পরের সব কথা লুকিয়ে রয়েছে ওই একটি না-কথার মুহূর্তে, কিন্তু তার আর খোঁজ নেই কোনো। তা ইতিহাসে নেই, স্মৃতিতে তো নেইই, উদযাপনের ঘনতার মধ্যে বুদবুদের মত উবে যাওয়া একটা সময়। এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।

আমি, এই সামান্য লেখায়, সেই মহা-সময়কে স্বীকৃতি জানাই। জানিয়ে, উৎপলকুমার বসুর একটি আশ্চর্য কবিতা উল্লেখ করি:


"মাংসখণ্ড মুখে নিয়ে কেমন সুন্দর দাঁড়িয়ে রয়েছে বাঘা,
সাঁকো পার হতে গিয়ে নিজেই নিজের ছবি দেখছে,
ভাবছে, আরেকটি কুকুর যেন (ঠিক ঐ মতো) মাংসখণ্ড
মুখে নিয়ে জলে ভাসছে --

তার ঊর্ধ্বে আমি (যে বাকি গল্প জানে) সিগারেট টানছি
আর ঝুঁকে পড়ে বইয়ের ছবিটা দেখছি--

তার আরেকটু উপরে, চিন্তিত পাঠক, তুমি, যে সিগারেট টানছ
আর বেশ তাড়াতাড়ি এই ছোট্ট লেখাটা পড়ে ফেললে,
ভাবছ -- আরেকবার প্রথম থেকে পড়ে দেখা যাক,
বাংলা কবিতার হল-টা কী?"


কবিতাটির প্রথম অনুচ্ছেদ পূর্বকল্পিত কোনো একটি দৃশ্য, কিন্তু সেই দৃশ্যটি কল্পনার ঘটমান বর্তমানে চিত্রিত। একটি কুকুর নিজের ছায়া দেখছে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে হঠাৎ কবি দৃশ্যের দূরত্ব অতিক্রম করে নিজেই হয়ে উঠছেন কর্তা। কবিতার ঘটমান বর্তমানে। আর তৃতীয় অনুচ্ছেদে কবি কবিতার ঘটমান বর্তমান থেকে স্বেচ্ছায় সরে যাচ্ছেন। তখন পাঠক অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছেন। ঘটমান বর্তমানে।

এখানে কি তবে সেই অবলুপ্ত সময়কে খানিকটা পুনরুদ্ধার করতে চাইছেন কবি? তিন স্তরের ঘটমান বর্তমান এক হচ্ছে যেই মুহূর্তে, সেই মুহূর্তে ত্রিপুরারি কবি তাঁর মায়া-বাণ সংযোজন করলেন বুঝি? দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ থেকেই তাঁর রচনাকালের 'নষ্ট' অনৈতিহাসিক সময় কবিতার মহাসময়ের অঙ্গী হয়ে যেতে শুরু করল না কি? তদুপরি, কবিতার অবলুপ্ত সময়ের ওপরে কবি কি পাঠককেও খানিক অধিকার দিলেন? না কি পাঠকের অবলুপ্ত সময় নিজে অধিকার করলেন? অর্থাৎ, কবিতাটি পড়ার পর পাঠকের ভাবনার যে সময়টুকু, সেই ভাবনাটা কবি নিজেই ভেবে দিলেন, পাঠক কেবল কবির বয়ানে নিজের ভাবনা পড়লেন? তাহলে কবি কি পাঠককে  অধিকার দিলেন, নাকি পাঠককে অধিকার করলেনও?

আরো কিছু সময় নষ্ট করে ভাবতে বসি বাংলা কবিতার এইসব আশ্চর্য কুহক।

You Might Also Like

2 comments

  1. চমৎকার। ভাবমৌলিকত্বে নিঃসন্দেহে চিন্তা্র খোরাক যোগায় এই লেখা। সময় 'নষ্ট' করে আবারো পড়ে দেখি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ!

      Delete

Talk to Me

Name

Email *

Message *